মহিম-রহিম
সুনির্মল বসু
- মহিম-রহিম দুটি ছোটো ছেলে-একমন একপ্রাণ মহিম সে গোঁড়া হিন্দুর ছেলে, রহিম মুসলমান।
- তাহলে কি হয়,-বন্ধু যে তারা, তফাৎ কে করে ভাই,-
■ দুটি ছোটো প্রাণ, তাজা দুটি ফুল, কোনো মলিনতা নাই। বালক রহিম মক্তবে পড়ে, মহিম পাঠশালায়,-
একই পথে রোজ মহা-উৎসাহে হাত ধরে তারা যায়।
মক্কা ও কাশী এক করে দিল দুটি ছোটো শিশু ভাই- জম জম জল গঙ্গায় এল-কোনো সন্দেহ নাই। মন্দিরে আর মসজিদে হল প্রাণে প্রাণে পরিচয়- চেরাগের বাতি পঞ্চপ্রদীপে গলাগলি করে রয়।
রহিমে-মহিমে কোলাকুলি হল-খোলাখুলি হল প্রাণ, এক হয়ে গেল উল্লাসে আজি আল্লা ও ভগবান। হিন্দুর ঘরে শিশুর মহলে কে আছ মহিম ভাই- মোল্লা ঘরের রহিম যে ডাকে, আয় আয় ছুটে তাই। আজ সে রহিম জুড়ে থাক্ ভাই প্রতি মুসলিম ঘর, মহিমের স্মৃতি ভরে থাক নিতি হিন্দুর অন্তর।
পাঠ-সহায়
কবি-পরিচিতি: সুনির্মল বসু ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাই বিহারের গিরিডিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের মালখানগরে। তাঁর পিতার নাম পশুপতি বসু। বাংলার শিশু সাহিত্যে তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। গল্প, ছড়া, নাটক, কবিতায় তিনি শিশু ও কিশোর মনের ছবি এঁকেছেন। তার রচিত গ্রন্থগুলি হল ছানাবড়া, কিপটে ঠাকুরদা, টুনটুনির গান, মরণের ডাক, আমার ছড়া, হই চই, বেড়ে মজা, হুলুস্থুলু, বীর শিকারি, ছন্দের টুংটুং প্রভৃতি। ১৯৫৬ সালে তিনি কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ 'ভুবনেশ্বরী' পদক লাভ করেন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর জীবনাবসান হয়। ২০০২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে।
কবিতার মূলভাব: কবিতাটির মূল সুর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। হিন্দু মুসলমান বিভেদ যে ধর্মীয় উন্মাদনার প্রকাশ তা আমরা জানি। কিন্তু কবি এই ভেদ মুছে দিয়ে অমলিন সম্প্রীতির কথা তুলে ধরেছেন কবিতায়। মহিম হিন্দু ঘরের ছেলে আর রহিম মুসলমান ঘরের। ধর্ম আলাদা হলেও তারা একপ্রাণ, যেন তাজা দুটি ফুল। তাদের কাছে মক্কা ও কাশী এক, আল্লা ও ভগবান একই ঈশ্বরের ভিন্ন নাম। কবি সবাইকে রহিম-মহিমের মতো হতে বলেছেন।
নামকরণ: বন্ধুত্ব কখনও ধর্মের বেড়া মানে না। সাম্প্রদায়িকতার পাঁকেই ফোটে চিরন্তন বন্ধুত্বের।
শতদল। কবিতায় সেই কথাটিই বড়ো হয়ে উঠেছে। মহিম গোঁড়া হিন্দুর ছেলে আর রহিম মুসলমানের
ছেলে। ধর্মভেদ তাদের আলাদা করতে পারেনি। তাদের কাছে আল্লা-ভগবান, কাশী-মক্কা, মন্দির-মসজিদ
সব মিলেমিশে একাকার। মহিম-রহিমের রক্তের রঙও এক। দুই বন্ধুর মিলন দৃশ্যকে তুলে ধরে কবি
কবিতার ভাষ্য রচনা করেছেন। তাই নামকরণটি সার্থক।
শব্দার্থ: একমন-একমন যাদের। একপ্রাণ-এক প্রাণ যাদের। গোঁড়া-প্রবল সংরক্ষণশীল। তফাৎ-পার্থক্য। মলিনতা-মালিন্য। মক্তবে-আরবি, ফারসি শিক্ষার প্রাথমিক বিদ্যালয়, এখানে মাদ্রাসায়। মক্কা-আরব। দেশের নগরী। এখানে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ হজ করতে যায়। কাশী-ভারতে অবস্থিত হিন্দু তীর্থ স্থান। চেরাগের প্রদীপের। কোলাকুলি-পরস্পরে আলিঙ্গন। উল্লাসে-আনন্দে। নিতি-নিত্য।
জমজম-মক্কায় অবস্থিত পবিত্র কূপ। স্মৃতি-স্মরণশক্তি।
অনুশীলনী
১। সঠিক উত্তরটি বেছে নিয়ে ফাঁকা ঘরে টিক (✔) চিহ্ন দাও:
১.১ মহিম-রহিম কবিতাটি লিখেছেন-
উত্তর: (খ) সুনির্মল বসু
১.২ মহিম-রহিমকে কবি বলেছেন-
উত্তর: (গ) দুটি তাজা প্রাণ
১.৩ বালক রহিম পড়ে-
উত্তর: (গ) মক্তবে
১.৪ রহিম আর মহিম রোজ হাত ধরে যায়-
উত্তর: (ক) একই পথে
১.৫ মহিমের স্মৃতিভরে থাক নিতি হিন্দুর-
উত্তর: (গ) অন্তর
২। পাঠ থেকে শব্দ নিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করো:
রহিম মহিমে কোলাকুলি হল, খোলাখুলি হল প্রাণ, এক হয়ে গেল আজিও উল্লাসে হিন্দুর ঘরে শিশুর কে আছ ভাই, মোল্লা ঘরের যে ডাকে, আয় আয় তাই।
৩। একটি বাক্যে উত্তর দাও:
(ক) মহিম কোথায় পড়ে?
মহিম পাঠশালায় পড়ে।
(খ) রহিম-মহিম কীভাবে স্কুলে যায়।
রহিম-মহিম হাত ধরে একই পথে স্কুলে যায়।
(গ) কারা গলাগলি করে রয়।
মন্দিরে আর মসজিদে চেরাগের বাতি গলাগলি করে রয়।
(ঘ) কী এক হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে?
মক্কাও কাশী এক করে দিল দুটি ছোটো শিশুভাই, আল্লা ও ভগবান এক হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। (
(ড) কোথায় দুজনের প্রাণে প্রাণে পরিচয় হল।
মন্দিরে আর মসজিদে দুজনের প্রাণে প্রাণে পরিচয় হল।
৪। সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও:
(ক) কোনো মলিনতা নাই।-কাদের মধ্যে, কেন মলিনতা নেই।
উত্তর: মহিম ও রহিম এই দুই শিশুর মধ্যে কোনো মলিনতা নেই। কারণ তারা দুজনই নির্মল, তাজা মনের। তাদের মধ্যে কোনো ধর্মীয় বিদ্বেষ বা পূর্বগ্রহ নেই।
(খ) কীভাবে জমজম আর গঙ্গারজল এক হল?
উত্তর: মহিম ও রহিমের মনে জমজম (মুসলিমদের পবিত্র জল) আর গঙ্গাজল (হিন্দুদের পবিত্র জল) এক হয়ে গেছে। অর্থাৎ, তারা ধর্মীয় বিশ্বাসের পার্থক্যকে তুচ্ছ করে, সকল ধর্মকে সমানভাবে গ্রহণ করেছে।
(গ) কীভাবে মহিম-রহিম মক্কা আর কাশীকে এক করে দিয়েছে।
উত্তর: মহিম ও রহিম তাদের মনে মক্কা (মুসলিমদের পবিত্র স্থান) আর কাশী (হিন্দুদের পবিত্র স্থান)কে এক করে দিয়েছে। অর্থাৎ, তারা সকল ধর্মের পবিত্র স্থানকে সমানভাবে সম্মান করে।
(ঘ) দুই বন্ধুর একমন একপ্রাণ না হলে কী হয়?
উত্তর: দুই বন্ধু যদি একমন একপ্রাণ না হয়, তাহলে তাদের মধ্যে বিভেদ তৈরি হতে পারে। ধর্ম, জাতি বা অন্যান্য কারণে তাদের মধ্যে মতভেদ হতে পারে।
(ঙ) কবি কাদের মহিম-রহিমের মতো হতে বলেছেন।
উত্তর: কবি সকল মানুষকে মহিম ও রহিমের মতো একতার সূত্রে আবদ্ধ হতে বলেছেন। তিনি চান সকলে ধর্ম, জাতি নির্বিশেষে এক হয়ে বাঁচুক।
৮। নীচের শব্দগুলির বাক্য রচনা করো:
· স্মৃতি:
আমার শৈশবের সুন্দর স্মৃতি এখনও মনে রয়েছে।
এই গানটি শুনলেই আমার মনে পুরানো স্মৃতি জাগে।
· প্রাণে প্রাণে:
সে তার বন্ধুকে প্রাণে প্রাণে ভালোবাসে।
দেশের জন্য তিনি প্রাণে প্রাণে লড়াই করেছিলেন।
· উৎসাহে:
শিক্ষকের উৎসাহে ছাত্রটি পরীক্ষায় ভাল ফল করেছে।
নতুন কাজ শুরু করার জন্য আমার মনে অনেক উৎসাহ।
· খোলাখুলি:
তারা খোলাখুলি কথা বলতে পারে।
সবাইকে খোলাখুলি মন দিয়ে কথা বলা উচিত।
· গলাগলি:
মন্দিরে চেরাগের বাতি গলাগলি করে জ্বলছে।
দুই বন্ধু গলাগলি করে কথা বলছিল।
Comments
Post a Comment